সকল সুখের ও সৌন্দর্যের মূল হচ্ছে সুস্বাস্থ্য। সুস্বাস্থ্য ছাড়া জীবনের সকল অর্জনই বৃথা। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাদ্য। অর্থাৎ সুস্থ খাবার, সুস্থ জীবন। যে খাদ্য দেহের জন্য ক্ষতিকর নয় বরং দেহের বৃদ্ধি, ক্ষয় পূরণ ও রোগ প্রতিরোধ করে তাই স্বাস্থ্যসম্মত বা নিরাপদ খাদ্য। নিরাপদ খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, দেশের প্রায় সকল খাদ্যেই ভেজাল রয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার আজ আমাদের নাগালের বাইরে। দেশের সকল মানুষ আজ খাদ্যে ভেজালের আতঙ্কে। খাদ্যে ভেজালের দৌরাত্মে জনজীবন আজ হুমকীর সম্মুখীন।
নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ বা খাদ্য সুরক্ষা বলতে খাদ্যবাহিত অসুস্থতা প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে খাদ্য ব্যবহার, প্রস্তুতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বা বিদ্যাকে বোঝায়।
জৈবসারের ব্যবহার (কম্পোস্ট সার, কেঁচো কম্পোস্ট, কুইক কম্পোস্ট) বৃদ্ধি করা। মাটি পরীক্ষা করে জমিতে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার নিয়ম মোতাবেক প্রয়োগ করা। ইউরিয়া সারের প্রয়োগ কমিয়ে ডিএপি সারের ব্যবহার বাড়ানো।
জৈব সারঃ
যেসব সার জীবের দেহ থেকে প্রাপ্ত অর্থাৎ উদ্ভিদ বা প্রাণির ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রস্তুত করা যায় তাদেরকে জৈব সার বলে। যেমনঃ গোবর সার, সবুজ সার, খৈল ইত্যাদি। গাছের প্রায় সব খাদ্য উপাদানেই জৈব সারে থাকে। জৈব সারের ব্যবহার গাছের বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কেঁচো সারঃ
কেঁচো খাবার খেয়ে মল হিসাবে যা ত্যাগ করে তাই কেঁচো সার। তরিতরকারির ফেলে দেওয়া অংশ, ফলমূলের খোসা, উদ্ভিদের লতাপাতা, পশুপাখির নাড়িভুঁড়ি, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, ছোট ছোট করে কাটা খড়কুটো খেয়ে কেঁচো জমির জন্য সার তৈরি করে। এ সার সব ধরণের ফসল ক্ষেতে ব্যবহার করা যায়।
কেঁচো সারের উপকারিতাঃ
উৎপাদন ও ফসলের গুণাগুণ বৃদ্ধি পায়। মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়, ফলে কেঁচো সার ব্যবহারে সেচের পানি কম লাগে। ক্ষারীয় লবণাক্ত মাটিতেও চাষাবাদ সম্ভব। রোগ ও পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়। জমিতে আগাছার ঝামেলা কম হয়। ফসলের বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা বাড়ে। অধিক কুশি, অধিক ছড়া ও দানা গঠন হয়। মাটির বুনট উন্নত হয়। রাসায়নিক সারের চাইতে খরচ অনেক কম হয়। পরিবেশ দূষণমুক্ত থাকে।
পুষ্টিমানঃ
জৈব পদার্থ দিয়ে সাধারণ সার তৈরির পরিবর্তে কেঁচো সার তৈরি করলে এর পুষ্টিমান সাত থেকে ১০ গুণ বাড়ে। সুহৃদ বাংলাদেশ কর্তৃক কুমিল্লা জেলায় উৎপাদিত কেঁচো সারের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি, পানি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণাগারে রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর মধ্যে-
জৈব পদার্থ ২৮ দশমিক ৩২ ভাগ,
নাইট্রোজেন ১ দশমিক ৫৭ ভাগ,
ফসফরাস ১ দশমিক ২৬ ভাগ,
পটাশিয়াম ২ দশমিক ৬০ ভাগ,
ক্যালসিয়াম ২ ভাগ,
ম্যাগনেসিয়াম দশমিক ৬৬ ভাগ,
সালফার দশমিক ৭৪ ভাগ,
আয়রন ৯৭৫ পিপিএম,
ম্যাংগানিজ ৭১২ পিপিএম,
বোরন ০.০৬ ভাগ,
জিঙ্ক ৪০০ পিপিএম,
কপার ২০ পিপিএম রয়েছে।
>নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় গুণগত পরিবর্তন আবশ্যক। আধুনিক ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে চাষাবাদের জন্য কৃষককে আগ্রহী করতে হবে। এ ছাড়া এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ ও সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
>সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সচেতনতার মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্যের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করতে হবে।
>নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে না পারলে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ করার কথা চিন্তাও করা যায় না। কৃষিতে ঢালাওভাবে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার হচ্ছে। ফলে শাক-সব্জি ও ফলসহ বিভিন্ন খাদ্যের মাধ্যমে কীটনাশক মানুষের দেহে প্রবেশ করছে, যা শরীরের জন্যে খুবই ক্ষতিকর। এই বিষয়ে কৃষকদের সচেতন করতে হবে। সরকার কোন কীটনাশক নিষিদ্ধ করেছে, কোনটার অনুমোদন দিয়েছে এবং কীটনাশক ব্যবহারের বিধি-বিধান ইত্যাদি বিষয়ে কৃষকদের সর্বশেষ তথ্য জানা আবশ্যক।
>খাদ্য কৃষক বাজারজাত করার সময় খাদ্য দূষিত করে, ক্রেতা ভালো পণ্যের সঙ্গে ভেজাল পণ্যের মিশ্রণ ঘটিয়ে খাদ্যের দূষণ ঘটায়। এই দূষণ রোধ করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। উৎপাদনের পরিবেশ খাদ্যের মানকে প্রভাবিত করে।
>বাজারের তাজা মাছ কোন পরিবেশে বড় হয়েছে, সেটি কিন্তু মাছের গুণগত মান নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। মাছকে যে খাবার দেওয়া হয়, তা থেকেও মানুষের শরীরে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। এ জন্য উৎপাদনের পরিবেশকে স্বাস্থ্যকর করতে হবে। নতুবা ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যাবে।
>মাংস উৎপাদনে অসচেতনভাবে ভেটেরিনারি ডোজ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।বাজারের তাজা মাছ কোন পরিবেশে বড় হয়েছে, সেটি কিন্তু মাছের গুণগত মান নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
>নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে আমাদেরকে নিম্নোক্ত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১। কৃষকদেরকে স্বাস্থ্যসম্মত আধুনিক চাষাবাদ সম্পর্কে প্রশিক্ষণসহ সচেতন করতে হবে।
২। যথাযথ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ছাড়া ফসলে কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
৩। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে।
৪। খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, পরিবহন, বিক্রয় ও ভোক্তার খাদ্য গ্রহণ প্রতিটি স্তরে খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
৫। নিরাপদ খাদ্য ও এ সংক্রান্ত বিষয়াদি পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৬। ফরমালিনসহ রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে এবং খাদ্য উৎপাদনকারী শ্রমিকদের সুস্বাস্থ্য ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
৭। খাদ্যের নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে সততা, স্বচ্ছতা ও দেশপ্রেমের সাথে কাজ করতে হবে।
৮। বাজারজাতকরণ, পরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্টদের এবং ভোক্তাদেরকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, নিরাপদ খাদ্য যেমন সবার জন্য প্রয়োজন। তেমনি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সকলকে সচেতনতার সাথে স্বীয় দায়িত্ব পালন করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য পণ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বিপণন প্রতিটি পর্যায়ে সচেতনতা প্রয়োজন। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব।